সামাজিক কোনো অনুষ্ঠান বা জনসমাগমে যাওয়ার আগে সতীর্থ বা অপরিচিতদের সঙ্গে কথা বলতে হবে ভেবে অনেকেরই উৎকণ্ঠা হয়। কোথাও বক্তৃতা বা কথা বলার আগে মানসিক চাপ অনুভব করা, ক্লাসে সবার সামনে শিক্ষক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে অস্বস্তি বোধ করা কিংবা লজ্জা অনুভব করার প্রবণতা অনেকের মধ্যেই আছে। এই ধরনের উদ্বেগ অনুভব করা অস্বাভাবিক নয়, সাধারণত কিছুক্ষণের মধ্যেই এই অস্বস্তি-ভাব কমে যায়।কিন্তু কারো কারো ক্ষেত্রে এই অস্বস্তি বা লজ্জার অনুভূতি এতোটাই প্রকট যে, এটি তার স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত করে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই লজ্জা বা ভীতিকর অনুভূতির নাম সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার।
সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার বা সামাজিক ভীতিতেয় আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণকে এতোটাই ভয় পান যে ওই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে তারা ভীত আর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এমন ব্যক্তিরা জন্য সাধারণ সামাজিক কাজকর্ম, অফিসের বার্ষিক সম্মেলন বা সভায় যোগদান, বক্তৃতা দেওয়া, বিবাহ অনুষ্ঠান বা জনসমাগমে যোগদান, বন্ধুদের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া ইত্যাদি দৈনন্দিন কাজে তীব্র উৎকণ্ঠা অনুভব করেন।
সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারের লক্ষণ
সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বিশেষ ধরনের শারীরিক ও আচরণগত উপসর্গ দেখা যায়। শারীরিক উপসর্গগুলো হলো-কাঁপুনি, অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, গা গোলানো, কথা বলার সময় তোতলানো ইত্যাদি। এইসব উপসর্গ ব্যক্তিকে নিজের সম্বন্ধে আরও উদ্বিগ্ন করে তোলে। তার মনে হতে থাকে যে চারপাশের সমস্ত ব্যক্তিরা উপসর্গগুলো নিয়ে বিদ্রূপ করছেন।এই ধারনা তার মধ্যে অপমান আর লজ্জাবোধ বাড়িয়ে তোলে। নিজেকে নিয়ে এতো বেশি চিন্তি হয়ে পড়ার ফলে ব্যক্তির মধ্যে নিম্নোক্ত পরিবর্তনগুলো দেখা দিতে পারে-
- অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে হবে এমন পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়া
- পারিবারিক এবং কর্মস্থলে ব্যক্তিগত সম্পর্ক এড়িয়ে চলা
- অন্যদের দিকে দৃষ্টিনিবন্দ করে কথা না বলা
এই উপসর্গগুলো ব্যক্তির জন্য কষ্টকর এবং তার সাধারণ জীবনযাপনে বাধা সৃষ্টি করে। যদি আপনার পরিচিত কারো মধ্যে এই উপসর্গগুলো লক্ষ্য করে থাকেন, তবে তার সঙ্গে এই সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করুনেএবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করুন।
সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার যেসব কারণে হতে পারে
বংশগত কারণ: গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার সাধারণত বংশগত সমস্যা। যদিও এটা এখনও স্পষ্টভাবে জানা যায়নি যে এটি জিনবাহী সমস্যা নাকি বাচ্চারা ছোটবেলা থেকে পরিবারে সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তিকে অনুসরণ করে উদ্বেগে ভুগতে আরম্ভ করে।
বাজে অভিজ্ঞতা: শৈশবকালে বা স্কুলে অবমাননার ঘটনা বা উৎপীড়নের অভিজ্ঞতা ব্যক্তির মনে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে যা পরবর্তী সময়ে তাকে উদ্বেগগ্রস্ত করে তোলে।
শৈশবকালে সঙ্কেত: যেসব শিশুরা খুব লাজুক বা মুখচোরা হয়, কৈশোরকালে তাদের মধ্যে সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারের চিকিৎসা
সামাজিক উদ্বেগ বিকার রূপে রোগীকে খুবই বিচলিত করে দিতে পারে। চিকিৎসার সাহায্যে রোগী নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে পান আর সামাজিক আড়ষ্টতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারেন। অন্যান্য উদ্বেগজনিত বিকারের মতোই সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারের চিকিৎসা ওষুধ, সাইকোথেরাপি বা দুটো পদ্ধতির সম্মিলিত ব্যবহারে করা হয়। কগনিটিভ বিহেভেরিয়াল থেরাপি (সি বি টি) সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারের চিকিৎসায় বিশেষভাবে উপযোগী। ওষুধের সেবন রোগীর উদ্বেগ আর অস্বস্তিভাব নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। কে কতদিনে সুস্থ হয়ে উঠবে সেই সময়সীমা প্রত্যেক রোগীর ক্ষেত্রে আলাদা, কিন্তু নিয়মিতভাবে চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরী।
সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত রোগীর পরিচর্যা
আপনার পরিচিত কোনো ব্যক্তির মধ্যে যদি সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারের কোনো উপসর্গ লক্ষ্য করেন, তবে তার সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করুন। প্রথমেই এই রোগের ব্যাপারে বিষদে জানুন যাতে আপনি রোগীর সমস্যা ভালো করে বুঝতে পারেন। রোগীকে চিকিৎসা আর থেরাপির কার্যকারিতা সম্পর্কে জানান এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে উৎসাহিত করুন। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে তার সঙ্গে যান। চিকিৎসা চলাকালীন রোগী যদি অসহিষ্ণু হয়ে পড়েন, তবে তার সঙ্গে ধৈর্যপূর্ণ ব্যবহার করুন। আপনার সহযোগিতা তাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে বিশেষভাবে সাহায্য করবে।
সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার মোকাবিলা
আপনার যদি মনে হয় যে আপনি সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার বা সোশ্যাল ফোবিয়ায় ভুগছেন, তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। যদি সরাসরি চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে দ্বিধা অনুভব করেন, তাহলে আপনার বিশ্বস্ত কোনো পরিচিতজনকে খুলে বলুন এবং তাকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যান। নিজের জীবন শৈলীতে কিছু পরিবর্তন আপনাকে ভালো থাকতে সাহায্য করবে। সামগ্রিক সুস্থতার জন্য বিশেষজ্ঞের মতামত অনুযায়ী একটা দিনলিপি নির্ধারণ করে সেটা মেনে চলুন। নিয়মিত ব্যায়াম করা আর পর্যাপ্ত ঘুম সুস্থ থাকার জন্য একান্ত জরুরি। একই ধরনের সমস্যায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের সঙ্গেযোগাযোগ স্থাপন করে তাদের সঙ্গে নিয়মিত কথাবার্তা বলুন। অনেকক্ষেত্রে চিকিৎসার ভালো ফল পেতে অনুমিত সময়ের চেয়ে একটু বেশি সময় লাগতে পারে। আশা ছেড়ে দেবেন না। চিকিৎসা চালিয়ে যান।
সূত্র: মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট অবলম্বনে