শিশুর অটিজম: অভিভাবকদের করণীয়

শিশুর অটিজম: অভিভাবকদের করণীয়

অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার মস্তিষ্কের একটি জটিল স্নায়ুবিক বৈকল্য; যা আজ বৈশ্বিক সর্বজনীন এবং জীবনব্যাপী সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে- প্রতি ১০০ জন শিশুর মধ্যে অন্তত একজন অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু রয়েছে। আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) তথ্যমতে- প্রতি ৩৬ জন শিশুর মাঝে একজন শিশু অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারে শনাক্ত হচ্ছে।

বিভিন্ন সমীক্ষায় এসেছে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় চারগুণ বেশি। কোনো এক নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া না গেলেও অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে জিনগত বৈচিত্র্যতাই উঠে এসেছে বিভিন্ন গবেষণায়।

একটি পরিবারে যখন একটি শিশুর জন্ম হয় তখন পরিবারের সবার উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে সেই শিশুটি। জন্মের পরপরই শিশুর চেহারা দেখে বোঝা অসম্ভব যে শিশুর অটিজমের বৈশিষ্ট্য আছে কি না, কারণ অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার অনেক জটিল বৈশিষ্ট্যের সমষ্টি, যেমন আচরণগত সমস্যা, সামাজিক যোগাযোগে বৈচিত্র্যতা ও পুনরাবৃত্তিমূলক বা সীমাবদ্ধ আচরণকে বুঝায় যা বয়সের সঙ্গে ধাপে ধাপে প্রকাশ পেতে থাকে।

অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার যে এক ধরনের প্রতিবন্ধিতা এটা অনেকেই বুঝতে পারেন না। মানুষের চেহারা বা শরীরের কোনো অঙ্গহানির মাধ্যমে অনেকেই প্রতিবন্ধিতাকে দৃশ্যমান করতে চান। ফলে অনেকেই অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর চেহারা বা শরীরে বৈচিত্র্য খুঁজতে থাকেন এবং অন্য কোনো প্রতিবন্ধি শিশুকে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ভেবে ভুল করে ফেলেন।

যখন একটি শিশু নাম ধরে ডাকলে তাকাচ্ছে না, মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে না, নির্দেশনা অনুসরণ করছে না কিংবা বয়স অনুযায়ী সঠিকভাবে কথা বলতে পারছে না বা ভাষা বুঝতে পারছে না তখন অনেকেই ধরে নেন যে হয়তো বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে। কথা বা ভাষার প্রকাশে বিলম্ব হওয়া আর অটিজম বৈশিষ্ট্যের প্রভাবে ভাষাগত বৈকল্য যে এক বিষয় নয় তা অনেক ক্ষেত্রেই বোধগম্য হয় না সবার। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর যেখানে দ্রুত শনাক্ত হওয়া এবং পরবর্তীতে সমন্বিত চিকিৎসার মাধ্যমে দ্রুত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ জরুরি সেখানে শিশুর বয়স বাড়ার সঙ্গে কথার বিকাশ হয়ে যাবে ভেবে অনেকেই বিলম্ব করতে থাকেন, ফলে শিশুর অটিজমজনিত বিভিন্ন সমস্যার বয়স উপযোগী চিকিৎসা থেকে শিশু বঞ্চিত হয়। অথচ অটিজম শিশুর একাংশ কথা বলতেও পারে আবার আরেকাংশ না-ও বলতে পারে কিন্তু তার মূল সমস্যা হলো সামাজিক যোগাযোগে।

অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর প্রত্যেকেই একে অপর থেকে আলাদা। প্রতিটি শিশুর জ্ঞানীয় প্রক্রিয়া, দক্ষতা অর্জনে সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করে কখনো এককভাবে, কখনো ছোট ছোট গ্রুপে তাদের উন্নতির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে বিভিন্ন চিকিৎসাব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু দেখা যায় এখানেও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আছে। অনেকেই অটিজমকে একটি জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা মনে করে এটিকে অস্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে থাকেন বা রোগ মনে করে এটি থেকে শিশুকে সারিয়ে তুলতে চান। এতে শিশুর অটিজম সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনাগত জটিলতা আরও বাড়তে থাকে।

অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুকে শিশু বিকাশ বিশেষজ্ঞ বা এ বিষয়ে দক্ষ শিশু চিকিৎসককে দেখানো জরুরি কারণ অটিজম বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে প্রায়ই সহাবস্থান করে এমন জটিলতা নির্ণয় ও চিকিৎসার (যেমন- খিঁচুনি, কোষ্ঠকাঠিন্য, ঘুমের সমস্যার চিকিৎসা, মস্তিষ্কের বিকাশ ও মনোযোগ বৃদ্ধিতে ওষুধ ও পরামর্শ প্রদান ইত্যাদি) গুরুত্ব রয়েছে।

অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর শারীরিকভাবে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি তার মানসিক বিকাশ ঠিকভাবে হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে সঠিক সময়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিভিন্ন টুলসভিত্তিক এসেসমেন্ট করা আবশ্যকীয় এবং এর মাধ্যমে শিশুর অটিজমের বৈশিষ্ট্যগুলোর বিশ্লেষণ এবং অটিজমের তীব্রতা কতখানি তা বিভিন্ন স্কোরিংয়ের মাধ্যমে বের হয়ে আসে। অনেক সময় অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর মা-বাবার মানসিক অবসাদ, দুশ্চিন্তা ও শিশুর যে অটিজম রয়েছে এ বিষয়টিকে মেনে নিতে ও মানিয়ে নিতে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, শিশু সাইকোলজিস্ট ও সাইকোথেরাপিস্ট এবং কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্টের পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনার প্রয়োজন রয়েছে।

অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর নানামুখী দক্ষতা অর্জনপূর্বক জীবনমান উন্নয়নে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ সর্বজন স্বীকৃত মাধ্যম হলো রিহ্যাবিলিটেশন স্বাস্থ্যসেবা যেমন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, ফিজিওথেরাপি। শিশুর প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়মিত এ থেরাপিসেবা নিতে হবে এবং বয়স ও শিশুর উন্নয়নের ওপর ভিত্তি করে এ থেরাপি পরিবর্তিত হবে।

অনেক সময় দীর্ঘ ও সংগ্রামী এ পথ পাড়ি দিতে হাঁপিয়ে ওঠেন অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর অভিভাবকরা। শিশুর অটিজম আছে তা মানতে না পারা, মানলেও কী করতে হবে বা কার কাছে যেতে হবে তা সঠিক সময়ে বুঝতে না পারা, পরিবারের অন্য সদস্যদের অসহযোগিতা ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের নেতিবাচক মনোভাবের জেরে মানসিকভাবে অনেক মা-বাবাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে অনেক মা-বাবার সম্পর্কের মাঝে দ্বন্দ্ব, কলহ-বিবাদ এক সময়ে বিচ্ছেদ পর্যন্তও গড়ায়, যাতে অনেক অটিজম শিশুর জীবন ভয়াবহ অনিরাপদ হয়ে ওঠে। তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদি, বহুমুখী ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে যেতে হয় বিধায় এটি যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষও বটে।

একটি শিশু যখন মাত্র মায়ের কোলজুড়ে বেড়ে ওঠা শুরু করে তখন এটা বোঝা বা বলা মুশকিল শিশুটি অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কিনা। ধীরে ধীরে বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ পেলে বা যে কোনো বিকাশজনিত সমস্যা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গেই অটিজম শনাক্তকরণ, সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং সমন্বিত চিকিৎসার আওতায় ব্যবস্থাপনা শুরু করতে হবে। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর বিভিন্ন দক্ষতা উন্নয়নে, দক্ষতার প্রয়োগে আমাদের সমাজের সবার ইতিবাচক চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর সীমাবদ্ধতাকে তার দুর্বলতা না ভেবে বরং সমাজের সব গোঁড়ামি ভেঙে এ খাতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি আমাদের সবার উন্নত মানসিকতাই পারে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় দেশকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিতে। পরিশেষে আমাদের সবার মন-মগজ ও মানসিকতায় অটিজম যেন রোগ বা সমস্যা হিসেবে না থেকে বরং একটি সহনীয় বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে থাকে সেটাই কামনা করি।

লেখক: স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি চিকিৎসক, নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ থেরাপি অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ফাউন্ডেশন এবং সভাপতি, সোসাইটি অব স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্টস।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *