ডিসলেক্সিয়া সম্পর্কে সচেতনতা

ডিসলেক্সিয়া সম্পর্কে সচেতনতা

ডিসলেক্সিয়া একটি স্নায়বিক ব্যাধি। ছোট শিশুদের মধ্যেই এর লক্ষণগুলো প্রথম অনুভব করা যায়। তবে এটি এমন একটি সমস্যা, যার নিরাময় নেই—যদিও চেষ্টা, একাগ্রতা ও ইচ্ছা থাকলে প্রায় সারিয়ে ফেলা সম্ভব।

শিক্ষক ক্লাসে একদিন কিছু শব্দ আলাদা করতে বলায় ৯-১০ বছরের ঈশান দেখল অক্ষরগুলো হঠাত্ যেন নেচে নেচে বেড়াচ্ছে চোখের সামনে। পড়তে তার ভীষণ অসুবিধা হয়। কোনো লেখাই যেন স্থির হয়ে দাঁড়ায় না একেবারেই!

২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়া জনপ্রিয় হিন্দি চলচ্চিত্র ‘তারে জামিন পার’-এর এই ছোট্ট ঈশানের সঙ্গে আমরা প্রায় অনেকেই পরিচিত। পড়ালেখায় অমনোযোগী হওয়ার দায়ে শিশুটিকে বাবা-মা ছেড়ে চলে যেতে হয় বোর্ডিং স্কুলে। কিন্তু পড়ালেখায় কোনো কারণ ছাড়াই অমনোযোগী ছিল না শিশুটি। তার ছিল ডিসলেক্সিয়া।

 

ডিসলেক্সিয়া মূলত স্নায়বিক সামঞ্জস্যের অভাব। এ থেকে আসে বিভিন্ন ধরনের পড়তে ও শিখতে না পারার অক্ষমতা। সাধারণত প্রতি ১০০ জনে একটি শিশুর মধ্যে দেখা দেয় এই সমস্যা। তবে আগের চেয়ে এখন এই সমস্যা বেশ পরিচিত একটি বিষয়। ডিসলেক্সিয়া শব্দটি গ্রিক শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ দাঁড়ায় ‘শব্দবিষয়ক সমস্যা’। ভারতের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশটির প্রায় ১৫ শতাংশ শিশু এই সমস্যায় ভুগছে। যুক্তরাজ্যে প্রতি ১০ জনের মধ্যে একটি শিশু এই সমস্যায় ভুগছে। জন্ম-পূর্ববর্তী সময়ে মাথায় কোনো ধরনের আঘাত পাওয়া এবং গর্ভবতী মায়ের অতিরিক্ত মাদক সেবন এই রোগের কারণ হতে পারে। তবে অনেক সময় এমনিতেও শিশুর মধ্যে এই রোগ দেখা যায়। এই লার্নিং ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত শিশুর লক্ষণগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে শিশুটি অক্ষরের সঙ্গে শব্দের তালমিল ঠিক রেখে পড়তে পারে না। ফলে শিশুটির উচ্চারণে সমস্যা তৈরি হয়। এমনকি সে যেহেতু অনেক ধীরে ধীরে পড়ে, তাই সে সবার সামনে পড়তেও লজ্জা ও সংকোচ বোধ করে থাকে। এছাড়া অক্ষরগুলোকে ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত অনেকেই চলমান বা ‘অক্ষরগুলো নাচছে’ এমন অবস্থায় দেখে। এ কারণে লেখার সময় প্রতিটি বাক্যের মাঝে স্পেসিংয়ের ভারসাম্য বজায় রাখতে অসুবিধা হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে বিষয়টি বেশি দেখা যায়। ফলে তাদের লেখা প্রায়ই আঁকাবাঁকা হয়।

ডিসলেক্সিয়া একটি জীবনব্যাপী সমস্যা। এর তেমন কোনো সমাধান নেই বললেই চলে। তবে চেষ্টা করলে এই রোগ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এজন্য শিশুকে সময় দিন। তার পড়তে সমস্যা হলে তার সামনে আপনি শব্দটি ভেঙ্গে ভেঙ্গে জোড়ে জোড়ে পড়ুন। তাকে তার সুবিধামতো মার্জিন বা লাইন টেনে লিখতে শেখান। সে পারছে না বলে যেন হাল ছেড়ে না দেয়। সে একটু দেরিতে বুঝছে বা পারছে বলে তার যে বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যা আছে, তা কিন্তু একেবারেই নয়! ডিসলেক্সিয়ায় আইকিউ-সংক্রান্ত কোনো সমস্যা থাকে না। তার বুঝে ওঠার অপেক্ষাকৃত ধীরগতির কারণে তাকে যেন কোনো সহপাঠী ‘বুলি’ করে নিচু দেখাতে না পারে এ বিষয়ে বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন। কারণ এতে করে শিশুর আত্মবিশ্বাস একেবারে শেষ হয়ে যেতে পারে। তাকে উৎসাহ দিন এই বলে যে বিল গেটস, অভিষেক বচ্চন ও আইনস্টাইনের মতো নামিদামি মানুষেরও এ সমস্যা ছিল। তার পরও তারা এ বিপত্তি অতিক্রম করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে তুলতে পেরেছেন। তাই সে-ও পারবে। এতে হীনম্মন্যতায় ভোগার আসলে কিছুই নেই। তাকে এ-ও বলতে পারেন যে, সে আসলে ব্যতিক্রমী। তাই সৃষ্টিকর্তা তাকে এরকম করে পাঠিয়েছেন।

কারণ পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ আলাদা। কেউ কারো মতো হতে পারে না। আপনার ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত শিশুটি যে বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে, সেখানকার শিক্ষকদের এ বিষয়ে অবগত রাখুন। তাদের সহযোগিতা শিশুটির একান্ত কাম্য। কারণ আপনি বাবা কিংবা মা হিসেবে সব সময় স্কুলে তাকে সাহায্য করার জন্য উপস্থিত থাকতে পারবেন না। প্রতিবেশীদের মধ্যে যাদের সঙ্গে মিশছে, প্রয়োজনে তাদেরও জানিয়ে রাখতে পারেন। এছাড়া বিশেষ ক্ষেত্রে কাউন্সিলরের শরণাপন্ন হতে পারেন। এ ধরনের শিশুর জন্য ‘অর্টন গিলিংহ্যাম অ্যাপ্রোচ’ নামে একটি কাঠামোভিত্তিক শিখনপদ্ধতি আছে। এটিও চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী! সব সমস্যার সমাধান না হলেও প্রতিকার খুঁজে পাওয়া যায় সহজেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *