অটিজম হলো শিশুদের স্নায়ুবিকাশজনিত একটি সমস্যা বা রোগ, যার কারণে একটি শিশু সামাজিক আচরণে দুর্বল হয়, পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে কম সক্ষম হয়। এ রোগটিকে একটি স্বতন্ত্র রোগ হিসাবে বিবেচনা করলে ভুল হবে (যদিও এ রোগটির কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে); বরং বোঝানো হয়ে থাকে-স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যাগুলোর সংমিশ্রণ, যেখানে আত্মসংবৃতি, অ্যাসপারজারের সংরক্ষণ (Asperger’ S syndrome) এবং পরিব্যাপক বিকাশমূলক ব্যাধির (pervasive developmental disorder, PDD) লক্ষণগুলো বিদ্যমান।
আবার এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশেষ এক ধরনের সিনড্রোম, যার নাম ‘ফ্র্যাজাইল এক্স সিনড্রোম (Fragile X syndrome, FXS)। যদিও অনেক বিশেষজ্ঞ FXS-কে সরাসরি অটিজমের অংশ হিসাবে গণ্য করেন না; বরং বলেন যে, FXS-আক্রান্ত রোগীদের অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। ফ্র্যাজাইল এক্স সিনড্রোম মানব X ক্রোমোজোমে FMR1 (ফ্র্যাজাইল এক্স মেসেঞ্জার রিবোনিউক্লিওপ্রোটিন) জিনের মধ্যে নিউক্লিওটাইড CGG ট্রিপলেট পুনরাবৃত্তির কারণে ঘটে, যার পুনরাবৃত্তি ৫৫ থেকে ২০০ পর্যন্ত দেখা যায়। ফলে FMR1-জিনটি অকার্যকর হয় এবং তার প্রোটিন (FMRP) তৈরিতে ঘাটতি দেখা দেয়।
এ কারণে স্নায়ুকোষগুলোর মধ্যে সংযোগের ত্রুটি ও এমনকি বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতাও পরিলক্ষিত হয়। অটিজমের যে উপসর্গগুলো দৃশ্যমান, তার মধ্যে যোগাযোগ ও বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতাই হচ্ছে প্রকট। তাই বর্তমানে শুধু অটিজমের পরিবর্তে এ মিশ্র-সমস্যাটি ‘অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার’ (এএসডি) বলে আখ্যায়িত হয়েছে এবং এ প্রবন্ধেও রোগটিকে সেভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
লক্ষণগুলো : এএসডি-আক্রান্ত শিশুদের আচরণ সাধারণ শিশুদের থেকে আলাদা। এক্ষেত্রে শিশুদের মধ্যে মানসিক সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। তারা সব সময় আত্মলীন থাকে, কারও সঙ্গে কথা বলে না, খেলা করে না, নিজের জগতেই নিজে বিচরণ করে এবং তাদের মধ্যে একই কাজ বারবার করার প্রবণতা দেখা যায়। তারা অন্যদের সঙ্গে ঠিকমতো মিশতেও পারে না। এ ছাড়াও অনেক সময় শিশুটির মা প্রথম বুঝতে পারেন যে, তার শিশুটি কথা বলতে পারছে না বা কথা বলতে দেরি হচ্ছে।
শিশুটির বাবা-মা স্বভাবতই উদ্বিগ্ন হন। তাদের আরও একটি বৈশিষ্ট্য প্রকট থাকে-তারা কারও চোখে চোখ রেখে কথা বলে না বা শোনে না। এমনকি নিজের বাবা বা মায়ের চোখের দিকেও এরা চোখ রাখতে পারে না। অনেকে হাইপার অ্যাকটিভ হয়, নিজের হাত কামড়িয়ে রক্তাক্ত করে বা হাতের কাছের জিনিসপত্র ভেঙে নষ্ট করে। তবে যাই হোক; অন্যান্য মানসিক ব্যাধির মতো এএসডিকে মানসিক ব্যাধি হিসাবে দেখার কোনো কারণ নেই।
এএসডি রোগে লিঙ্গ পার্থক্য : বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন, প্রতি ৫৪ জনের মধ্যে একটি শিশুর এএসডি হওয়ার প্রবণতা আছে। এ রোগটি সমগ্র আর্থ-সামাজিক স্তরেই দেখা যায়। তবে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের এএসডি হওয়ার আশঙ্কা উল্লেখযোগ্য হারে বেশি; অর্থাৎ ছেলে থেকে মেয়ে ৪:১ অনুপাতে। এ লিঙ্গ পার্থক্যের অন্তর্নিহিত জিনগত কারণ লুকিয়ে রয়েছে মানুষের সেক্স-ক্রোমোজমে। গবেষণায় দেখা গেছে, মানব এক্স (X)-ক্রোমোজমে অবস্থিত নিউরোলিগিন নামক একটি জিনের মিউটেশন এএসডির একটি অন্যতম কারণ। নিউরোলিগিন প্রোটিনটি স্নায়ুগুলোর মধ্যে সিন্যাপসিস (সংযোগস্থল) স্থাপন এবং বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যাতে করে স্নায়ুকোষগুলোর মধ্যে যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন থাকে।
যেহেতু মেয়েদের সেক্স-ক্রোমোজমের দুটিই হলো X ক্রোমোজম এবং ছেলেদের মধ্যে একটি X ও একটি Y; কাজেই একটি X ক্রোমোজমে ঘটে যাওয়া NLGN4X-জিনটির মিউটেশন আরেকটি X ক্রোমোজমের স্বাভাবিক NLGN4X জিন দ্বারা সুরক্ষা পায়। কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে Y ক্রোমোজমে যেহেতু কার্যকরীভাবে সমতুল্য জিন থাকে না, তাই তারা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত। প্রসঙ্গত, সাধারণ অবস্থায় মেয়েদের দুটি X ক্রোমোজমের একটি নিষ্ক্রিয় থাকে। তবে এক্ষেত্রে NLGN4X জিনটি নিষ্ক্রিয়করণ থেকে মুক্তি পেয়ে একটি স্বাভাবিক প্রোটিন তৈরি করে মেয়েদের সুরক্ষিত রাখে।
কখনো এই শিশুরাই আবার বিশেষ গুণে পারদর্শী হয়। বিশ্বখ্যাত অনেক মনীষী আছেন, যারা অটিজম রোগে আক্রান্ত ছিলেন। দেখা গেছে, এএসডি-আক্রান্ত কিছু মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জীবনে অবিশ্বাস্যভাবে সফলতা এনেছে। অনেক উদাহরণ রয়েছে, তবে দুজন বিজ্ঞানীর নাম উল্লেখ না করলেই নয়। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও নোবেল জয়ী আলবার্ট আইনস্টাইন অটিস্টিক ছিলেন এবং তিনিও কথা বলা শুরু করেছেন অনেক দেরিতে। আইজ্যাক নিউটনও অটিস্টিক ছিলেন। ২০২২ সালের অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী ভার্নন স্মিথ আক্রান্ত ছিলেন অ্যাসপার্জার সিনড্রোমে।
কারণগুলো : এএসডি সৃষ্টির একাধিক কারণ রয়েছে, যার ফলে এ রোগের সঠিক চিকিৎসাও জটিল হয়ে পড়েছে। দুই দশকের নিবিড় গবেষণার ফলাফল থেকে অটিজমের কারণ সম্বন্ধে এখন অনেকটা স্পষ্ট ধারণা হয়েছে। একটি ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন যে, আমাদের মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন কোষের পারস্পরিক সংযোগ কমে যাওয়া বা বিচ্ছিন্ন হওয়া কিংবা স্নায়ু থেকে নিঃসৃত কিছু রাসায়নিক পদার্থের অভাব হওয়ার কারণেই শিশুদের এএসডি রোগ দেখা দেয়। যাই হোক, এএসডির পেছনে দুটি মূল কারণ হচ্ছে জিনগত ও পরিবেশগত সমস্যা।
জিনগত কারণ : FMR1 জিনের মিউটেশন ও নিউক্লিওটাইড-পুনরাবৃত্তি ছাড়াও, মানব এক্স (X)-ক্রোমোজমে অবস্থিত নিউরোলিগিন (Neuroligin, NLGN4) জিনের মিউটেশন অটিজমের একটি অন্যতম কারণ, যা আগেই উল্লেখ করেছি। স্নায়ুকোষগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখার জন্য প্রিসিন্যাপটিক নিউরেক্সিন প্রোটিন এবং পোস্টসিন্যাপটিক নিউরোলিগিন প্রোটিন-দুটি সরাসরি জড়িত এবং সংকেত সংবহনে ত্রুটির কারণেই সৃষ্টি হয় এএসডিসহ নানা স্নায়ুবিকাশ সম্পর্কিত রোগ। নিউরোলিগিন পরিবারের চারটি জিন রয়েছে; তন্মধ্যে NLGN3 ও NLGN4 জিনের একাধিক মিউটেশনকে এএসডির কারণ হিসাবে দায়ী করা হয়েছে।
শ্যাঙ্ক (SHANK) প্রোটিন হলো পোস্টসিনাপটিক নিউরোনের একটি মাল্টিডোমেন স্ক্যাফোল্ড প্রোটিন, যা নিউরোট্রান্সমিটার রিসেপ্টর, আয়ন চ্যানেল এবং অন্যান্য মেমব্রেন প্রোটিনকে অ্যাক্টিন সাইটোস্কেলটন এবং জি-প্রোটিন-যুক্ত সিগন্যালিং পাথওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এ প্রোটিনগুলো সিন্যাপস গঠনেও ভূমিকা পালন করে। Shank-জিনের মিউটেশন এএসডি রোগের কারণ হিসাবে চিহ্নিত। বিশেষ কিছু জিনের কপি নাম্বার বৈচিত্র্য (Copy number variation, CNV) এএসডি-রোগের একটি বড় কারণ হিসাবে স্বীকৃত।
CNV আমাদের জিনোমের কোনো জিন বা ডিএনএ খণ্ডের কপি বা অনুলিপির সংখ্যাকে বোঝায়। জিনোমে CNV বৈচিত্র্য আনে ডুপ্লিকেশন এবং ডিলিশন জিনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ডুপ্লিকেশনের মাধ্যমে কারও জিনোমে নির্দিষ্ট কোনো একটি জিনের অনেক কপি দেখা যায়; কিন্তু অন্যদের মাঝে ডিলিশনের কারণে ওই একই জিনটির কপি নাম্বার অনেকাংশে কম পাওয়া যায়। CNV-র ক্লাসিক উদাহরণ হিসাবে আমরা অ্যামাইলেজ জিনটিকে তুলে ধরি। মানব জিনোমে বিশেষ কিছু জিনের সংখ্যার এ পরিবর্তন (ডুপ্লিকেশন বা ডিলিশন) শিশুদের স্নায়ুবিকাশে এক বড় পরিণতি ডেকে আনে। মানব জিনোমের ১৫নং ক্রোমোজোমের এক প্রান্তে, ঠিক 15q11.2 লোকাসে, এ ধরনের একটি ভঙ্গুর অঞ্চল রয়েছে, যেখানে অবস্থান করে চারটি জিন-TUBGCP5, NIPA1, NIPA2 ও CYFIP1। গবেষষণায় দেখা গেছে, শেষোক্ত দুটি (NIPA2 ও CYFIP1) জিন মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্স, হিপ্পোক্যাম্পাস ও সেরেবেলাম অঞ্চলগুলোতে প্রকাশ পায় এবং জিনগুলোর CNV এএসডি ও অন্যান্য স্নায়ুবিকাশজনিত ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
স্বাভাবিক সিন্যাপটিক ফাংশন এবং আচরণ বজায় রাখতে CYFIP1 (cytoplasmic FMR1 interacting protein1) সিন্যাপসগুলোতে NMDA গ্লুটামেট রিসেপ্টর এবং সংশ্লিষ্ট উপাদানগুলোর প্রোটিন সংশ্লেষণকে নিয়ন্ত্রণ করে। রোগের স্পেকট্রাম বিশেষে জিনটির ডুপ্লিকেশন বা ডিলিশন এএসডির অন্যতম একটি কারণ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। এমনকি CYFIP1 জিনটির ডোজ পরিবর্তন করে গবেষকরা উত্তেজক এবং প্রতিরোধমূলক সংকেত-সংবহনের দ্বিমুখী প্রভাব প্রকাশ করেছেন।
গবেষণামূলক একটি বড় সমীক্ষায় আরও একটি বিষয় উদ্ঘাটিত হয়েছে যে, এএসডি-আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ক্যানাবিনোয়েড (CBD) উপাদানগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এ নিরীক্ষণটি প্রমাণ করে, শিশুদের এএসডি-সম্পর্কিত সামাজিক আচরণের অস্বাভাবিকতার পেছনে অভ্যন্তরীণ CBD-গুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
পরিবেশগত কারণ : গর্ভাবস্থার প্রথম দুটি মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সময়ে মায়েদের সংক্রমণকে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের মতো স্নায়ুবিকাশজনিত অবস্থার ঝুঁকির কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সময়ে গর্ভবতী মায়েদের ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসজনিত সংক্রমণের কারণে তাদের দেহে যেসব অ্যান্টিবডি তৈরি করে, তা এএসডি সৃষ্টির জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে। প্রসঙ্গত, গর্ভাবস্থার তৃতীয় সপ্তাহে ভ্রুণের মস্তিষ্কের বিকাশ শুরু হয়। নবম সপ্তাহের মধ্যে, মস্তিষ্ক একটি ছোট, মসৃণ গঠন হিসাবে উপস্থিত হয় এবং দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের শেষে, ভ্রুণের মস্তিষ্ক সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয়।
এছাড়াও, গর্ভধারণের সময় পিতামাতার বেশি বয়স, বায়ু দূষণ, মাতৃ-স্থূলতা, ডায়াবেটিস বা ইমিউন সিস্টেমের ব্যাধি, শিশুর মস্তিষ্কে প্রসবকালীন অক্সিজেন প্রতিবন্ধকতা এএসডি-র কারণ হতে পারে। পরিবেশের বিষাক্ত উপকরণ (যেমন মার্কারি, আর্সেনিক, কীটনাশক ইত্যাদি) গর্ভাবস্থায় শিশুর বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ের মস্তিষ্কের কোষগুলোকে ধ্বংস করতে পারে। গর্ভাবস্থায় অধিক দুশ্চিন্তা করা, পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, অতিমাত্রায় ওষুধ সেবন, মায়ের ধূমপান ও মদ্যপান এএসডির সূত্রপাত হিসাবেও বিবেচনা করা হচ্ছে।
এএসডি রোগের প্রতিকার : শিশুদের মধ্যে এএসডির কোনো লক্ষণ দেখতে পাওয়া গেলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। অজ্ঞানতা সবসময়ই সমস্যা সমাধানের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তাই এএসডি-আক্রান্ত শিশুদের অভিভাবকদের এ রোগটি সম্বন্ধে সচেতন করে প্রয়োজন। নইলে দেরি হয় রোগ নির্ণয় ও নিরাময় করতে, তৈরি হয় নতুন জটিলতা। বর্তমানে অটিজম চিকিৎসার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আক্রান্ত শিশুদের বিভিন্ন ধরনের কাউন্সেলিং ও থেরাপি গ্রহণ করা উচিত। অনেক চিকিৎসক বিশেষ করে ‘আচরণ এবং যোগাযোগ বৃদ্ধিকারক থেরাপি করার পরামর্শ দেন। এসব থেরাপি আক্রান্ত শিশুদের অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে শেখায়। এএসডি আক্রান্ত অনেক শিশুর মধ্যে হাইপার অ্যাকটিভিটি, অনিদ্রা, খিঁচুনি জাতীয় রোগ দেখা যায়। তবে ঠিক সময়ে দক্ষ চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে দেখা গিয়েছে এদের অনেকেই সমাজের স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসে।
দুঃখের বিষয় এএসডি রোগের নিরাময়ের ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল চিকিৎসায় অদ্যাবধি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়নি। গবেষকরা নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন; কিন্তু এএসডি-এর জিনগত ও বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা, ব্যাপকতা এবং বহুমাত্রিক রূপ চিকিৎসা বিকাশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিয়েছে। সে কারণে এ রোগটির প্রতিকার হিসাবে কোনো জাদুকরী ওষুধ বর্তমানে নেই। যেসব প্রচলিত অ্যান্টিসাইকোটিক ও অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ এএসডি চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়, তার কার্যকারিতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে সেগুলোর ব্যবহার থেকে বিরত থাকতেই বলেন। বর্তমানে এএসডির যেসব জিনগত কারণগুলো চিহ্নিত হয়েছে সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে বেশ কিছু নতুন প্রজন্মের ওষুধ পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে।
আশা করি, নতুন প্রজন্মের এ ওষুধগুলো এএসডি নিরাময়ে অচিরেই উল্লেখযোগ্য ফলাফল এনে দেবে। আবার অনেক নিউরোবিজ্ঞানী স্টেমকোষ থেরাপিকেও এএসডি নিরাময়যোগ্য কৌশল হিসাবে দেখছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, সতর্কতা হিসাবে প্রসবপূর্ব ফলিক অ্যাসিড (Folic acid/ভিটা.বি৯)সহ মাল্টিভিটামিন গ্রহণ অটিজম ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। অধিকন্তু গর্ভাবস্থায় ভিটামিন ও সম্পূরক গ্রহণ নির্দিষ্ট পরিবেশগত দূষকগুলোর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের জন্য সুরক্ষামূলক প্রভাব প্রদান করতে পারে। এছাড়া ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ, ডিম, ফল ও সবজি শিশুদের এএসডি বিকাশকেও প্রতিহত করে। কারণ এ খাবারগুলোর মধ্যেই রয়েছে প্রাকৃতিক আনন্দ-মাইড, CB1 রিসেপ্টরের লাইগ্যান্ড।
উপসংহার : অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার বিভিন্ন শিশুর মধ্যে বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। শিশুরা মোটামুটি ৩ বছর বয়সের আগে তেমনভাবে কথা বলতেও শেখে না বলে এএসডি নির্ণয় হয় অনেক দেরিতে। অটিস্টিক চিলড্রেনস ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন-২০১১ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় তিন লাখ শিশু অটিজমে আক্রান্ত, যেখানে প্রতি ৯৪ জন ছেলের মধ্যে একজন এবং প্রতি ১৫০ জন মেয়ের মধ্যে একজন এএসডি রোগে আক্রান্ত বলে অনুমান করা হয়েছিল। ১৮-৩৬ মাসের শিশুদের নিয়ে ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষায় আক্রান্ত শিশুদের পরিসংখ্যান আগের তথ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলে ঢাকায় অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিস অর্ডার ও অটিজমের (IPNA) গবেষকরা উল্লেখ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি (CDC) কেন্দ্রের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রতি ৩৬টি শিশুর মধ্যে একজন শিশুর ধরা পড়ে এএসডি ১৬। তবে জিনগত অবকাঠামো ও অঞ্চল ভিত্তিতে এ পরিসংখ্যানের পার্থক্য রয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর এপ্রিল মাসে ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ পালন করা হয়। বাংলাদেশেও তা উদযাপন করা হয়; কিন্তু এএসডি-সংক্রান্ত গবেষণায় ও চিকিৎসা-ব্যবস্থায় গবেষকদের উচ্চ গুণমানসম্পন্ন অংশীদারত্ব দেখা যায় না। বলতেই হয়, পৃথিবীর অন্য উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে অটিজম গবেষণা অনেকটাই পিছিয়ে। আশা করি, সরকার ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এএসডি সম্বন্ধে আরও সচেতনতামূলক ও গবেষণামূলক-কার্যক্রম গ্রহণ করবেন। এছাড়াও প্রয়োজন সরকার থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা।
প্রফেসর ড. রাশিদুল হক : সাবেক উপউপাচার্য, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী; সাবেক অধ্যাপক, এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়, আটলান্টা, যুক্তরাষ্ট্র